ভূমিকা:
সেক্স ফেরোমন হচ্ছে এক ধরনের জৈব রাসায়নিকপদার্থ যা কোন প্রজাতির স্ত্রী পোকা কর্তৃক একই প্রজাতির পুরুষ পোকাকে প্রজনন কার্যে আকৃষ্ট করার জন্য প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়। সেক্স ফেরোমনের গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার সহিত মিলিত হয়। স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিঃসৃত পদার্থের গন্ধটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করে সেক্স ফেরোমন ফাঁদে ব্যবহার করা হয়। ফাঁদটি সহজ লভ্য ও সস্তা দ্রব্যাদি দিয়ে তৈরি অথচ পোকা ধরার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। কৃষকের নিকট এটি যাদুর ফাঁদ নামে পরিচিত।
সেক্স ফেরোমন ফাঁদের সুবিধা:
- এটি মানুষ বা পরিবেশের কোনরুপ ক্ষতি করে না
- সেক্স ফেরোমন ব্যবহারে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়
- ফসলের ক্ষতিকর পোকা কার্যকর ভাবে দমন হয়
- বালাইনাশকের প্রতি পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না
- ফলন বৃদ্ধি পায়।
ফেরোমন ফাঁদা স্থাপনের উদ্দেশ্য:
- পোকার উপস্থিতি মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করা
- অধিক হারে পুরুষ পোকা আটকানো
- পোকার প্রজনন কাজে বাঁধা সৃষ্টি করা।
ফেরোমন ফাঁদ তৈরির উপকরণ:
- সেক্স ফেরোমন টোপ (লিউর)
- একটি প্লাষ্টিক বৈয়ম (ফাঁদ)
- ফাঁদটি মাঠে স্থাপনের জন্য ১/২টি খুঁটি
- গুড়া সাবান
- পানি।
ফেরোমন ফাঁদ তৈরি:
ফেরোমন ফাঁদ তৈরির জন্য সাধারণত তিনটি উপাদান প্রয়োজন হয় যেমন-ফেরোমন টোপ, একটি ফাঁদ (বৈয়াম) এবং ফাঁদ স্থাপনের জন্য ১/২টি খুঁটি। এ ফাঁদে ২২ সেমি. লম্বা চার কোণাকৃতি বা গোলাকার একটি প্লাষ্টিকের পাত্র ব্যবহার করা হয়। বৈয়ামের তলদেশে ৩/৪ সেমি. সাবান মিশ্রিত পানি রাখতে হবে এবং পানির ২/৩ সেমি. উপরে টোপ ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
প্রথমত প্রায় তিন লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাযুক্ত ২২ সেমি. গোলকার বা চার কোণা বিশিষ্ট প্লাষ্টিকের পাত্র (বৈয়াম) এর উভয় পার্শ্বে পাত্রের নিচ বা তলা হতে ৪-৫ সেমি. উঁচুতে ত্রিভূজাকারে কেটে ফেলতে হবে। ত্রিভূজের নিচের বাহু সাধারণত ১০-১২ সেমি. এবং উচ্চতা ১১-১২ সেমি. হওয়া বাঞ্চণীয়।
দ্বিতীয়ত সাবান মিশ্রিত পানি সব সময় পাত্রের তলা হতে উপরের দিকে কমপক্ষে ৩-৪ সেমি. পর্যন্ত রাখা আবশ্যক। পাত্রের ঢাকনার মাঝে কালো রং এর একটি ল্যুপ বসানো থাকে। ল্যুপের নিচের ছিদ্রে সরু তার বাঁধা হয়। তারের অপর মাথায় ফেরোমন সম্বলিত টিউব (লিউর) এমনভাবে বাঁধতে হবে যেন লিউরটি সাবান মিশ্রিত পানি হতে ২-৩ সেমি. উপরে থাকে। সতর্ক থাকতে হবে যেন পাত্রের তলায় রক্ষিত সাবান পানি শুকিয়ে না যায়। যত্নের সাথে ব্যবহার করলে একটি পাত্র (বৈয়াম) ২-৩ মৌসুম পর্যন্ত চলতে পারে।
জমিতে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের সময়:
বেগুন ফসল: বেগুন ফসলের জমিতে সাধারণত চারা রোপণের ২/৩ সপ্তাহ পর হতেই বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। অতএর ফসলের এ পর্যায় হতেই ফাঁদ স্থাপন করা আবশ্যক। পোকা সফলভাবে দমন করার জন্য শেষবার ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফেরোমন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে।
কুমড়াজাতীয় ফসল: কুমড়া জাতীয় ফসলের কচি ফুল বা কচি ফলে মাছি পোকা আক্রমণ করে। তাই ফুল আসার সাথে সাথে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। কুমড়াজাতীয় সব্জির মাছি পোকা সফলভাবে দমন করার জন্য শেষবার ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফেরোমন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে।
কপিজাতীয় ফসল: চারা লাগানোর ১২-১৫ দিন পর হতে পোকার ফেরোমন ফাঁদ জমিতে স্থাপন করতে হবে। পোকা সফলভাবে দমন করার জন্য ফসল সংগ্রহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফেরোমন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে।
ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের হার:
ফসল ও পোকা ভেদে ভিন্ন
ফেরোমন ফাঁদের নাম | একর প্রতি সংখ্যা | বিঘা প্রতি সংখ্যা | ফাঁদ থেকে ফাঁদের দূরত্ব |
বিএসএফবি | ৪০ টি | ১৩-১৪ টি | ১০ মি. |
কুমড়া জাতীয় সব্জির মাছি পোকার ফাঁদ | ৩২ টি | ১১ টি | ১২ মি. |
ফলের মাছি পোকার ফাঁদ | ৩২ টি | ১১ টি | ১২ মি. |
স্পোডোপ্টেরা পোকার ফাঁদ | ১৮ টি | ৬ টি | ২৫ মি. |
ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন কৌশল:
- প্লাষ্টিকের বৈয়ামের ত্রিকোণাকা কর্তিত অংশের মাঝ বরাবর তার ঝুলিয়ে দিয়ে ফেরোমন লিউর/টোপটি ঝুলিয়ে দিতে হবে
- ফাঁদের কর্তিত অংশ উত্তর দিক বরাবর মূখ করে ঝুলাতে হবে
- সব্জি ফসলে গাছের উচ্চতা বরাবর ফাঁ স্থাপন করতে হবে।
ফেরোমন ফাঁদ ও টোপ পরিবর্তনের সময়:
- সাবধানতা ও যত্নের সাথে ব্যবহার করলে একটি ফাঁদ ২-৩ মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার কর যায়
- অতিরিক্ত বৃষ্টি, রোদ বা বাতাসে ফাঁদ নষ্ট হতে পারে, সে ক্ষেত্রে দেরী না করে জমিতে নতুন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে।
ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের পর করণীয়:
- প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে
- প্রতিদিন ফাঁদের পানি পরীক্ষা করে মরে থাকা পোকা ফাঁদের পানি থেকে আঙ্গুল/কাঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে
- ৩/৪ দিন পর পর সাবান পানি পাল্টে দিতে হবে
- সাবান পানির স্তর সর্বদাই ৩-৪ সেমি. রাখতে হবে
- ফাঁটা বা ছিদ্রযুক্ত ফাঁদ পরিবর্তন করে নতুন ফাঁদ প্রতিস্থাপন করতে হবে
- সব্জি ফসলের ক্ষেত্রে গাছের বৃদ্ধির সাথে সাধে ফাঁদটিকেও ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে তুলতে হবে
- নির্দিষ্ট সময় পর লিউর পরিবর্তন করতে হবে।
ফেরেোমন ফাঁদ ব্যবহারের সতর্কতা:
- বেগুন ও কপি জাতীয় ফসলের লিউর স্থাপনের সময় লিউরটির মুখ কোনভাবেই খোলা যাবে না
- লিউর কোনভাবেই পানিতে ভিজানো যাবে না
- প্যাকেট কাটার পর পরই লিউরটি ব্যবহার করতে হবে, কোন ক্রমেই পরবর্তী ব্যবহারের জন্য রাখা যাবে না
- কুমড়া জাতীয় ফসলের লিউরের প্যাকেট ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে এবং বেগুন ও কপি জাতীয় ফসলের লিউর ডিপ চেম্বারে রাখতে হবে।
কামরুল আলম
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা।